হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ এবং মুসলমানদের বিশ্ব সম্মিলন। সামর্থ্যবানদের ওপর জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ।

বায়তুল্লাহ শরিফে গমনাগমনের, হজের যাবতীয় খরচ বহনের এবং এই সময়ে পরিবারের ভরণ-পোষণের সামর্থ্য রয়েছে তাদের ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে। বাংলাদেশিদের জন্য হজের ধারাবাহিক কাজ উল্লেখ করা হলো।

প্রাথমিক কাজ:

১. বিমানে আরোহণের আগে যথাযথ নিয়মে ইহরাম বাঁধা।

২. বিমান থেকে জিদ্দায় নেমে মক্কায় নির্দিষ্ট বাড়িতে বা অবস্থানে গিয়ে ব্যাগ রেখে প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে অজু করে মুয়াল্লিমের মনোনীত লোকের সঙ্গে কাবাঘরে গমন।

৩. প্রাথমিক তাওয়াফ করা। সাতবার কাবা ঘরের চারদিকে ঘুরতে হবে। কাবাঘরের হাজরে আসওয়াদ যে কোণায় স্থাপিত সেখান থেকে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা। সম্ভব না হলে হাজরে আসওয়াদের দিকে হাত ইশারা করে সে হাতের ওপর চুম্বন করে তাওয়াফ শুরু করতে হবে।

 

৪. সাত চক্করের প্রথম তিন চক্করে একটু দ্রুত চলে শক্তি প্রদর্শন করতে হবে। এটাকে ‘রমল’ বলে। তাওয়াফের সময় পুরুষের গায়ের চাদর ডান হাতের নিচ দিয়ে এনে বাম কাঁধে রাখতে হবে যেন ডান কাঁধ ও বাহু বের হয়ে থাকে। এটাকে ‘ইজতেবা’ বলে। এ দুটি তাওয়াফের সুন্নত যা তাওয়াফে জিয়ারতেও করতে হবে। অতিরিক্ত উমরার তাওয়াফেও তা করতে হয়।

৫. সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াতে হবে সাতবার। শুরু করতে হবে সাফা থেকে, সপ্তমবার দৌড় শেষ হবে মারওয়ায়।

৬. এরপর মাথা মুড়াতে হবে বা চুল ছাটতে হবে।

৭. এরপরে মূল হজের কয়েক দিন বাকি থাকলে ইহরাম ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পরা যাবে। মুয়াল্লিমের মনোনীত লোকের সঙ্গে মদিনায়ও যাওয়া যেতে পারে। মূল হজের আগে ইহরাম ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাকে হজ্জে তামাত্তু বলে। সাধারণত আমাদের দেশের হাজি সাহেবরা এ হজেরই নিয়ত করে থাকেন।

মূল কাজ:

হজের মূল কাজ শুরু হয় ৮ জিলহজ, শেষ হয় ১২ জিলহজ। এ পাঁচ দিনের কাজগুলো সচেতনতার সঙ্গে যথার্থভাবে আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে চারটি ফরজ ও ওয়াজিবের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

৮. এদিন নিজ কামরায় অথবা কাবাঘরে বসে হজের ইহরাম বেঁধে মক্কা শরিফ থেকে মুয়াল্লিমের ব্যবস্থাপনায় অথবা নিজস্ব উদ্যোগে (মুয়াল্লিম না থাকলে) ‘মিনায়’ (মক্কার কাছাকাছি একটি উপশহর) পৌঁছাতে হবে। সেখানে ওই দিন জোহর, আছর, মাগরিব, ইশা এবং পরের দিনের ফজর (মোট পাঁচ ওয়াক্ত) নামাজ আদায় করতে হবে।

৯. সকালে মিনা থেকে রওনা হয়ে আরাফাতের প্রান্তরে পৌঁছতে হবে। এখানে জোহর ও আছর একত্রে পড়তে হবে। খুতবার পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত তালবিয়া, তাহমিদ, দোয়া-দরুদ, ইসতিগফার ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করতে হবে। সূর্যাস্তের পর মাগরিব না পড়ে মুজদালিফার উদ্দেশে রওনা হতে হবে। মাগরিবের ওয়াক্ত চলে গেলেও, রাত গভীর হলেও মুজদালিফায় পৌঁছার পরেই মাগরিব ও ইশার নামাজ একত্রে পড়তে হবে।

মাগরিবের ওয়াক্ত চলে যায় এ বিবেচনায় কোনোক্রমেই যাত্রাবিরতি করে মাগরিব পড়া যাবে না। মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও ইশা পড়াটাই হজের আহকাম। এ রাতে (৯ তারিখের দিবাগত রাত) মুজদালিফায় বিশ্রাম নিতে বা ঘুমাতে হবে। ফজর পড়ে সূর্যোদয়ের আগে আবার মিনার উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। মুজদালিফা প্রান্তর থেকে ন্যূনতম ৪৯টি পাথর (ছোট) সঙ্গে আনতে হবে।

 

১০. মুজদালিফা থেকে রওনা হয়ে মিনা পৌঁছতে হবে। এদিন কেবল শয়তানের বড় স্তম্ভে (জামরাতে আকাবা) ৭টি পাথর মারতে হবে। অন্য স্তম্ভগুলোতে এদিন পাথর মারা যাবে না। (জামরাতে) পাথর মারার পর কুরবানির নির্দিষ্ট নিয়মে একটি কুরবানি করতে হবে। এদিন ক্ষতিপূরণমূলক কুরবানি (দম) করা যাবে এবং একাধিক নফল কুরবানি করারও সুযোগ রয়েছে। কুরবানি করার পর মাথা মুড়াতে হবে অথবা চুল ছাঁটতে হবে।

এদিন এসব কাজ সমাধা করার পর ফরজ তাওয়াফ বা তাওয়াফে জিয়ারত করতে হবে। অবশ্য ভিড় এড়ানোর জন্য এ তাওয়াফ ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্বিত করা যেতে পারে। ১২ তারিখ সকালে তিনটি স্তম্ভে পাথর মেরে মিনা থেকে চূড়ান্তভাবে বিদায় হয়ে মক্কা শরিফে এসেও এ ফরজ তাওয়াফের সুযোগ রয়েছে। এর আগে করলে আবার পাথর মারার জন্য মিনায় ফিরে যেতে হবে।

১১. শয়তানের উদ্দেশে তিনটি স্তম্ভে সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারতে হবে।

১২. তিনটি স্তম্ভে আবার সাতটি করে মোট ২১টি পাথর মারতে হবে। এভাবে পাথর মারার সংখ্যা হবে ১০ জিলহজ ৭টি+১১ জিলহজ ২১টি+১২ জিলহজ ২১টি = মোট ৪৯টি। তাওয়াফে জিয়ারত ১০ বা ১১ তারিখ না করলে এদিন অবশ্যই সূর্যাস্তের আগে সমাধা করতে হবে। ১১ ও ১২ তারিখে পাথর মারার সময় ছোট থেকে বড় স্তম্ভের দিকে যেতে হবে। ১২ তারিখের পর একজন হাজি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

 

১০ জিলহজ মাথা মুড়ানোর পরই ইহরাম অবস্থার অবসান হয়। তবে তাওয়াফে জিয়ারতের আগে স্ত্রী সহবাস জায়েয হবে না। হজের আগে মদিনায় না গেলে এখন মদিনায় গিয়ে আট দিন অবস্থান করতে হবে এবং মসজিদে নববীতে মোট ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে। উল্লেখ্য, মদিনায় গমন করা হজের আহকামের অংশ নয়। তবে বিনা ওজরে বা কোনো সমস্যা ছাড়া মদিনা না যাওয়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে বেয়াদবির নামান্তর।

হজের পরে মক্কা শরিফে অবস্থান করলে তখন একাধিক উমরা করা যেতে পারে। হজ শেষ হওয়ার আগে বেশি উমরা না করাই উত্তম। কোনো কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে মূল হজই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিমান ছাড়ার দিন-ক্ষণ নির্দিষ্ট হয়ে গেলে বিদায়ের আগে বিদায়ী তাওয়াফ করা। এটা একেবারে শেষ কাজ। এটা ওয়াজিব। আল্লাহতায়ালা সামর্থ্যবান মুসলমানদের হৃদয়ে হজ পালনের বাসনা জাগিয়ে তুলুন এবং আমাদেরকে হজব্রত পালনের তাওফিক দান করুন।